Your browser does not meet the minimum requirements of this website. Though you can continue browsing, some features may not be available to you.
Browser unsupported
Please note that our site has been optimized for a modern browser environment. You are using »an unsupported or outdated software«. We recommend that you perform a free upgrade to any of the following alternatives:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সরকার পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। বিক্ষোভ, আন্দোলন কিংবা দাবি আদায়ের সংগ্রামও এই ভূখণ্ডে অচেনা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রবণতাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এটি কোনো নির্বাচিত সরকারকে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান বা প্রকাশ্য শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অপসারণের প্রচেষ্টা নয়; বরং আইন, প্রতিষ্ঠান ও বর্ণনার (narrative) মাধ্যমে ধাপে ধাপে অকার্যকর করে তোলার একটি সুপরিকল্পিত নকশা।
এই নকশার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—দুটি মৌলিক স্তম্ভ—এক ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এ বাস্তবতাকেই আরও নির্মমভাবে সামনে এনে দিয়েছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীতে বিক্ষোভ, শাহবাগ মোড় অবরোধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা—এসবের মধ্যেই ঢাকার কারওয়ান বাজারে দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয় এবং ফার্মগেটে অবস্থিত ডেইলি স্টার-এর প্রধান কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বহু সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকিতে পড়েন (ইত্তেফাক, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫)।
প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। প্রতিটি স্বজনহারা পরিবারের শোক আমাদেরও ছুঁয়ে যায়—কারণ আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে স্বজনহারার বেদনা বহন করি। কিন্তু সেই বেদনা কি সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণকে ন্যায্যতা দিতে পারে? এই প্রশ্নটি আজ জাতির সামনে দাঁড়িয়ে।
এদিকে দেশ যেন এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। খুলনার ডুমুরিয়ায় সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে; তিনি শলুয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন (যুগান্তর, ১৯ ডিসেম্বর)। একই সময়ে সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ড্রোন হামলায় নিহত ছয় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর মরদেহ দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলছে। তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বশান্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহলে তাদের প্রতি গভীর সম্মান জানানো হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০ ডিসেম্বরকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়।
এই সব ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এগুলো একটি বড় রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাকে “মেটিকুলাস ডিজাইন” বলা হচ্ছে, তা কি শেষ পর্যন্ত “নির্বাচিত সরকার উৎখাতের সুপরিকল্পিত নকশা”কেই নির্দেশ করে না? এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে অবৈধ বা অকার্যকর প্রমাণের চেষ্টা করা হয়; আদালত, প্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে টেনে আনা হয়; সাংবিধানিক সীমার ভেতরে থাকার ভান করা হলেও বাস্তবে সংবিধানের মূল চেতনাকেই দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। রাজনৈতিক তত্ত্বে একে বলা হয় গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ (Democratic Backsliding)।
এই প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশ আজ প্রতিষ্ঠানগত ক্ষয় ও তথাকথিত **“হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা”**র ঝুঁকির মুখে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান—সবই রাজনৈতিক আস্থার সংকটে ভুগছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, যে বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইতিহাস রচনা করেছিল, সেই বাহিনীর নৈতিক মনোবল আজ ভেঙে পড়েছে। রাজারবাগের প্রতিরোধ ছিল শুধু সামরিক নয়—নৈতিক ও প্রতীকী অর্থেও ছিল অসীম তাৎপর্যপূর্ণ। তা প্রমাণ করেছিল, বাঙালি জাতি নিপীড়নের কাছে মাথা নত করে না। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া কি কোনো অপরাধ? এই প্রশ্ন তোলাই কি প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার-এর অপরাধ?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ তারিখে ঘোষিত নির্বাচনকেও অনেকে এই সুপরিকল্পিত নকশার অংশ বলে সন্দেহ করছেন। অভিযোগ উঠছে—নিরপেক্ষ রেফারি হওয়ার বদলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রকৌশলের অংশে পরিণত হয়েছে। এর ফল দাঁড়াতে পারে এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে নির্বাচন থাকবে, সংসদ থাকবে—কিন্তু ক্ষমতার প্রকৃত উৎস নির্বাচনের বাইরে নির্ধারিত হবে।
বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই এই প্রক্রিয়ার প্রথম ও প্রধান শিকার। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, রিমান্ডে নিয়ে নিপীড়ন, ডিজিটাল ও নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, ভিন্নমতকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দেওয়া—এসব নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখন তা এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে।
ফলে সারাদেশে একটি ভয়ভিত্তিক নীরবতা—climate of fear—গড়ে উঠেছে, যেখানে গণতান্ত্রিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
এই আগুন যদি এখনই নেভানো না যায়, তবে শুধু একটি সরকার নয়—পুড়ে যাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, গণমাধ্যম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাধীন কণ্ঠ।