'যে কোন বাঙালির মনে প্রশ্ন আসবেই, স্বাধীনতার সময় আমাদের পত্রিকাগুলো কি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল? প্রতিমাসে আমাদের খবরগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ছিল। আমি সেই সময়কার বিভিন্ন দেশের পত্রিকা আর্কাইভ, ইন্টারনেট থেকে খুঁজে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি। একাত্তরের মার্চের পূর্ববর্তী সময় থেকে শুরু করেছিলাম। বিদেশী পত্রিকাগুলো বিশেষ করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, দেশটা ধীরে ধীরে সংঘাতের দিকে আগাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ করেছে, তাদেরকে আলোকপাত করার ভীষণ ইচ্ছা ছিল। কোন মাসে কোথায় যুদ্ধটা কিভাবে আগাচ্ছে, গেরিলাদের সাক্ষাৎকার, যুদ্ধ পরবর্তীকালে বীরঙ্গনাদের সংখ্যা কতটুকু সঠিক ছিল তা নিয়ে জাতিসংঘে অনেক চিঠি লেখা হয়েছিল। শেখ মুজিবের বাংলাদেশে ফেরত এবং তার যে বিচার হয়েছিল সেগুলোও লিপিবদ্ধ করেছি। বহির্বিশ্বের মানুষেরা এই যুদ্ধকে কিভাবে দেখছে এবং যুদ্ধের গভীরতম ব্যাপারগুলো আমি প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলাম',- নিজের প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে এভাবেই বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলেন আবদুল্লাহ জাহিদ।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সম্প্রচার 'টক অব দ্যা উইক' অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। উপস্থাপনায় ছিলেন ফরিদা ইয়াসমীন।
আবদুল্লাহ জাহিদ বর্তমানে নিউইয়র্কের কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরিতে ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আবদুল্লাহ জাহিদ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্য বিজ্ঞানে অনার্স করেছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের পরিকল্পনা উন্নয়ন একাডেমি থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে ডিপ্লোমা রয়েছে তার। পরবর্তীতে তিনি 'সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক' থেকে লাইব্রেরি এবং ইনফরমেশন সায়েন্স মাস্টার্স করেছেন।
লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে জানতে চাইলে আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, 'আমি মূলত একজন পাঠক, পড়তে ভালোবাসি। লেখালিখি শুরু করেছি অনেক পরে। ময়মনসিংহে থাকার সময় একজন প্রতিবেশীর বিশাল লাইব্রেরিতে বাংলা সাহিত্যের সমস্ত ক্লাসিক বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বইগুলো পড়ার সময় মনে হত আমি কি কোনদিন এভাবে লিখতে পারবো? আমেরিকায় আসার পর ইচ্ছা ছিল জার্নালিজমে পড়াশোনা করবো, জার্নালিস্টিক লেখা লিখবো, কিন্তু সেটা পরবর্তীতে সম্ভব হয়নি। বাবা-মা'র ইচ্ছা অনুসারেই ময়মনসিংহে পড়াশোনা করেছি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও শেষমেশ হয়নি। প্রায় ২৫-২৬ বছর আগে, আমেরিকায় আসার পর একদিন একটা লেখা যায় যায় দিন পত্রিকায় পাঠালাম। শফিক রহমান লেখাটা পড়ে উৎসাহের সাথে আমাকে একটা গাইড লাইন দিলেন। এভাবেই ঠিক গল্প আকারে নয় বরং একধরনের জার্নালিস্টিক টাইপের লেখা শুরু হয়।'
আবদুল্লাহ জাহিদ মূলত নন ফিকশন টাইপের লেখা লেখেন। যা লিখতে গেলে অনেক গবেষণা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের লেখকেরা সাধরাণত গবেষণামুলক লেখা লিখতে চান না। কিন্তু লাইব্রেরিতে কাজ করার দরুণ আমার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ থাকার কারণে নন ফিকশন লেখাটা সম্ভব হয়ে ওঠে। প্রথম আলোতে প্রায় একবছর যাবত আমার লেখা একটি কলাম 'বিশ্ব সংবাদপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ' ছাপা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে বই আকারে বাতিঘর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়।'
এছাড়াও সাপ্তাহিক যায়যায়দিন ম্যাগাজিনে আবদুল্লাহ জাহিদের 'ম্যানহাটন ডায়রি' নামে জনপ্রিয় একটি কলাম ছিল যা পরে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পড়ে অনেকেই অভিমত জানিয়েছেন। তারমধ্যে একজন ছিলেন ক্যাপ্টেন শহীদ, সিয়েরা লিওনে বসবাসরত একজন আর্মি অফিসার। যিনি পরে স্থানীয় হামলায় মৃত্যু বরণ করেন।
সাহিত্যে অনুবাদের জটিলতা নিয়ে ফরিদা ইয়াসমীন প্রশ্ন রাখেন, আমরা জানি ইংলিশে কিছু শব্দ আছে যা বাংলায় উপযুক্ত আকারে পাওয়া মুশকিল। আবার বাংলায় এমন কিছু শব্দ ও আবেগময়ী ভাব আছে যা ইংলিশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনুবাদের ক্ষেত্রে এই জটিলতা কীভাবে সমাধান করেন? আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, 'অনুবাদ কখনো পুরোপুরি সম্ভব না, লেখক কেবলমাত্র ভাবানুবাদ করতে পারেন। বাংলায় অনেক শব্দ আছে যা কখনো ইংরেজিতে করা সম্ভব না। তেমনি ইংরেজির কিছু শব্দকে বাংলায় রূপান্তর করা যায় না। এই পরিস্থিতিতে লেখককে ভাবানুবাদ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। ফিকশন টাইপের কিছু কবিতা ছাড়া আমি তেমন কিছু অনুবাদ করি নাই। 'গিফট অফ ম্যাজাই' নিয়ে একটা অনুবাদের সময় আমি চেষ্টা করেছি যাতে বাংলাদেশি পাঠকরা ভালোভাবে বুঝতে পারে।'
আলোচনাকালে এইচ বি রিতা বলেন, 'গল্পের চাইতে কবিতার অনুবাদ বেশি জটিল, কারণ এখানে আবেগের প্রকাশ ঘটে। বাংলায় আবেগকে প্রকাশের জন্য যে সব শব্দ, বাক্য থাকে তা অনেক সময় সঠিক ইংরেজিতে আনা সম্ভব না। আবার গদ্যের ক্ষেত্রে অনেকেই ফ্রেজ কিংবা ইডিয়মসে গড়মিল করেন।' আপনি কি মনে করেন যে অনুবাদের ক্ষেত্রে কাউকে এই বিষয়গুলোর ব্যবহার সম্পর্কে জানা জরুরি? এইচ বিতার এমন প্রশ্নে আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, 'রবীন্দ্রনাথ ইংরেজির দক্ষতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিলেন না। অথচ তিনি ইংরেজি শিখতে ইংল্যান্ড পর্যন্ত গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা ভ্রমনের সমস্ত তথ্য আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জোগাড় করেছি। রবীন্দ্রনাথের সাথে হ্যারিয়েট মুডির অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা তখনই জানতে পারি। তাদের লেখা চিঠিগুলো থেকে একটা ফিকশনের মতো তৈরি করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ তার চিত্রাঙ্গদা কাব্যটা হ্যারিয়েট কে উৎসর্গ করেছিল। তাই আমি ফিকশনটির নাম দিয়েছিলাম 'চিত্রার প্রেমে রবীন্দ্রনাথ।'
এইচ বি রিতা আরো যুক্ত করেন, 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গীতাঞ্জলি' প্রথাগত ছন্দের বাইরে গিয়ে নতুন এক শৈলীর সূচনা করেছিল। ১৯১০ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি মোট ১৫৭টি গীতিকবিতার সংকলন ও পদ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংলিজ ভার্সন 'সং অফারিংস্' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এতে গীতাঞ্জলির ১৫৭টি গান/কবিতা থেকে মাত্র ৫১টি নেয়া হয় এবং সমসাময়িক আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা সহ মোট ১০৩ টি লেখা রবীন্দ্রনাথ নিজে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন।'
আবদুল্লাহ জাহিদ তার গবেষণা মূলক গ্রন্থ 'বিশ্বসংবাদপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ' সম্পর্কে বলার সময় স্মৃতিচারণ করে জানান, 'এন্থনী মাসকারেনহাস ছিলেন একজন পাকিস্তানি উর্দুভাষী খ্রিষ্টান সাংবাদিক। পাকিস্তানের "দ্যা মর্নিং নিউজ"র সংবাদদাতা ছিলেন। বাংলাদেশে আসলে কি ঘটছে তা সরেজমিনে দেখার জন্যে সরকারী নির্দেশনাতেই তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তদন্ত শেষে তিনি বুঝেছিলেন যে নিউজটা পাকিস্তানে প্রকাশ করা বিপদজনক হবে। তাই সপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানকার 'টাইম' পত্রিকায় কাজ করার সময় বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে নিউজ প্রকাশ করেন।'
বাংলা সাহিত্য টিকিয়ে রাখতে সাহিত্য চর্চা-অনুশীলনের বিষয়টা কতটা জরুরি এই মর্মে আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, 'লেখা বেশি হওয়া ভালো, তবে বেশি প্রকাশনার ফলে মান তখন মধ্যম হয়ে যায়। যেমন এবারে একুশের বইমেলায় সাতশো'র বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিছু নীচু মানের বই বাদেও আজকাল ভালো লেখকের উন্নতমানের প্রকাশনা রয়েছে। আমাদের দেশে আগের চেয়ে সাহিত্যে চর্চা বেশি হচ্ছে, অনেকেই পরিশ্রম করে প্রতিবছরই কিছু উল্লেখযোগ্য লেখা বের করছেন।'
আবদুল্লাহ জাহিদ মনে করেন কেবল বই পড়লেই জ্ঞান বৃদ্ধি পায় না, লেখকের নিজস্ব পছন্দই আসল ব্যাপার। তিনি বলেন, 'পাঠকদের মধ্যে থেকেই লেখক তৈরি হয়। পড়ার জন্যে এখন বই ছাড়াও বিভিন্ন ডিভাইস আছে। তাই তাদেরকে জেনেরালাইজ করলে চলবে না। একজন লেখককে তার লেখার মান উন্নত ও সমৃদ্ধ করার কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে লেখার ব্যাপারে অবশ্যই বই পড়তে হবে, জানতে হবে এবং চর্চা করতে হবে।'
'এ দেশের লাইব্রেরি গুলোতে বাঙালি লেখকদের বই স্থান দেয়ার কোনো সুযোগ আছে কি-ফরিদা ইয়াসমীনের এমন প্রশ্নে আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, 'অবশ্যই সুযোগ আছে। নিউইয়র্ক সিটির বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা যেমন জ্যাকসন হাইটস, হইস, জ্যামাইকা, সেন্ট্রাল লাইবেরিতে বাংলা বই আছে। স্থানীয় লেখকদের বই লাইব্রেরি আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। অনেকেই তাদের ভালো লেখা আমাকে দিয়েছেন, আমি পড়েছি। কোন বাঙালি লেখকের বই পড়ে দেখে শুনে লাইব্রেরিতে যুক্ত করার সেই অথোরিটি আমার আছে। বুক শেলফ সাজানোর জন্যে এখানের লাইব্রেরিতে বই রাখে না, তারা বইটার সার্কুলেশন দেখে। দুঃখজনক ভাবে সবার বই একসঙ্গে রাখাও সম্ভব না। বাংলাদেশের নামকরা লেখকদের তুলনায় নতুন লেখকদের জায়গা করে নিতে একটু বেগ পেতে হয়। তবে আমি চেষ্টা করি এখানের লোকাল বাঙালি লেখকদের ভালো বই যুক্ত করতে। তাদের উচিত হবে একটা বইয়ের বদলে বেশ কিছু প্রকাশনা দেয়া। কারণ একটা বই লাইব্রেরির ক্যাটালগে রাখতে লাব্রেরিয়ান কে সময় দিতে হয়।'
আবদুল্লাহ জাহিদ কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্যে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেন। লাইব্রেরিতে কাজ করার সুবাদে বই নিয়েই তার দিনের একটা বড় সময় কাটে। লাইব্রেরিতে অবসর সময়ে শুধু বাংলা বই নয়, অন্য বই পড়ার এবং আলোচনার সুযোগ করে নেন তিনি। অনেকে বছরে একাধিক বই প্রকাশ করলেও আবদুল্লাহ জাহিদের ক্ষেত্রে একটা বইই সম্ভব হয়।
ভাষার মাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ফরিদা ইয়াসমানের উপস্থাপনায় আলোচনা পর্বটি এভাবেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। পরিচালনায় ছিলেন এইচ বি রিতা। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার 'টক অফ দ্য উইক' অনুষ্ঠানটি প্রতি বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক সময় রাত নয়টায় ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে।
সৌজন্যে : উত্তর আমেরিকা প্রথম আলো