ফেলে আসা দিনগুলো দেলোয়ার জাহিদ ট্যাক্সি ডাকা হয়েছে । গত দু’দিনে ব্রাসেলস শহরটা বেশ ভাল লেগেছে । ক’জন প্রবাসী বাঙালিকে নিয়ে সিটি সেন্টার সহ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছি। ৯৫’ সালের মাঝামাঝি ইউরোপে আমার প্রথম সফর বা বলা চলে স্বেচ্ছা- নির্বাসন। আমষ্টারডাম বিমান বন্দর নেমে ট্রেন চেপে এসেছিলাম ব্রাসেলসে। সে থেকে ইউরোপে প্রবাস জীবনের শুরু। বই পত্রের ব্যাগটা আবার ও দেখে নিলাম। যার বাসায় উঠলাম তাকে সবাই চেয়ারম্যান বলে ডাকে। আসল নামটি তার মনে পড়ছেনা। প্রবাসে অনেকের নামই এভাবে হারিয়ে যায় প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে। ভাই, ট্যাক্সি এসে গেছে। এবার বিদায়ের পালা। দু’দিনের পরিচয়, তারপরও আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। যেন কতদিনের চেনা। বাঙালীপনার এযেন এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। ব্যাগ নিয়ে দু’তলা থেকে নীচে নেমে এলাম। ট্যাক্সিতে ব্যাগগুলো তুলে দেয়া হলো। আমাদের টিকেট হোষ্টদেরই কাছে । আমার আবার সব কিছুই খতিয়ে দেখার বাতিক আছে। তবু ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। ওরা ও ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন। দুপুরে ট্রেন। অনেকটা সময় ট্রেনে থাকতে হবে প্রায় ৬৩৩ কিলোমিটার পথ। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ছাড়লো। ট্রেনের চাকার শব্দে একটু তন্দ্রা এলো। সারাটা ট্রেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা । প্লাটফরমে নেই ফেরীওয়ালাদের হাকডাক ব্যস্ত সমস্ত মানুষের এদিক ওদিক ছুটাছুটি। মানুষের মাথাগুলো যেন হাতে যায় গুনা । আশে পাশে সহযাত্রীদের ঠোট নাড়া দেখা যায় কিন্তু কথা বা শব্দ শুনা যায় না । বাংলাদেশে বাস বা ট্রেন চড়ে আমি বেশ অভ্যস্ত। কষ্ট সহিষ্ঞ্চুতার জন্য বন্ধুরা কখনো কখনো আমাকে কৌতুক করে গান্ধী জুনিওর বলে ডাকতো। সেকেন্ড বা থার্ড ক্লাশেই বেশী ট্রেন চড়া হতো। ফার্ষ্ট ক্লাশে যখনই দূর দূরান্তে কোথাও যেতাম মনে হতো ইন্জিন যেন একটি বিচ্ছিন্ন বগিকে নিয়ে সামনে এগুচ্ছে আর বাকী বগিগুলো পিছু সরে যাচ্ছে। পাসপোর্ট এন্ড টিকেট প্লিজ---চেকারের কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। সিদ্ধান্তহীনতার দূলাচলে কাটলো ক’দিন। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলাম। ফ্রাইবুর্গের রিফিউজি ক্যাম্পে সে এক ভিন্ন জীবন। এ ক্যাম্পে নানাহ ভাষা, নানাহ বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষের এক অপূর্ব মিলন মেলা। সবাই একই নিয়মনীতির বেড়াজালে যেন বন্দী। বিশ পচিশ জন বাঙালী যুবককে একই ক্যাম্পে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। কখনো হাতে ক্যান, কখনো ব্যস্ত ধুমপানে। নিজকে তাদের কাছ থেকে একটু ঘুটিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র নাম মিজান। তার সাথে কিছুক্ষনের কথাবার্তায় পারিবারিক সংস্কার এবং ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠলো। নামাজ কালাম পড়া এবং পরোপকারের গুনগুলো আমার কাছে ফুটে উঠতে বেশী সময় লাগলো না। কিছুটা একাকীত্ব দূর হলো। কিভাবে হালাল খাবার খাওয়া যায় মিজান তার কিছু ধারনা তুলে ধরলো। ক্যাম্পের আবাসিক কক্ষগুলোতে পাক করা বেআইনী। তারপরও অনেকেই পাকায়। লাইন দাড়িয়ে খাবার নেয়া আমার অহংবোধে বেশ বাধতো। মনে হতো ’৭১ এর সে দিনগুলো। ১৯৭১ সালের নয় মাসে দীর্ঘ সংগ্রাম, প্রতিরোধ আর গেরিলা যুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার-ও আলবদরদের নাস্তানাবুদ করে বেঁচে থাকা, দুর্গম পথের বাধা, নদী, যানবাহনের অপ্রতুলতা কোন কিছুই তো আমাদের সে সময়ের যুদ্ধ আর অগ্রাযাত্রার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই, রিফিউজি হবার এ বাস্তবতাকে ও মেনে নিতে হবে। ফ্রাইবুর্গ একটি ছোট্র শহর। জার্মানের দক্ষিন পশ্চিম সীমান্তে বাডেন-বুডেনেবার্গে এর অবস্হান। শহরের পশ্চিম দিয়ে বয়ে গেছে ড্রাইসেম নদী। পশ্চিম কিনারায় ব্ল্যাক ফরেষ্ট। যাকে জার্মান ভাষায় বলা হয় সূয়ার্জ বাল্ড। ১২৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেইন নদী বয়ে গেছে ফ্রাইবুর্গের পার্শ্ব দিয়ে। রেইন এর বিস্তৃতি জার্মান, ইটালী, অষ্ট্রিয়া, লিসটেন ষ্টাইন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড পর্যন্ত । এযেন বাংলার আরেক প্রতিরূপ, ৭০০ নদ-নদী ঘিরে রয়েছে সারা বাংলাদেশ। জার্মানের এ্যাসাইলাম পলিসি সম্পর্কে প্রাক কোন ধারনা ছিলো না। ইইউ মাইগ্রেশান এতটা জার্মানীকরণ করা হয়েছে তা বুঝতে একটু সময় কেটে গেলো। সেইফ থার্ড কান্ট্রি কন্সেপ্ট এবং মৌলিক অধিকার প্রশ্নে জার্মানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী আমাকে বেশ বিব্রত করলো। আমি তখন নিজ জগতে ফিরে গেলাম, প্রতিবাদের ভাষা তখন ভাষান্তর হতে শুরু করলো। ভুলে গেলাম আমি কেবল আমারই সমস্যার কারনে জার্মান এসেছি। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী হয়েছি। চা ও খাবার বিরতি ছাড়া ৮ ঘন্টা করে টানা তিনদিন ই্ন্টারভিউ চললো। নিজের সমস্যাগুলোর ও সংক্ষিপ্ত কিছু বর্ননা দিলাম। তার মধ্যে সমাজকন্ঠের ডিক্লারেশন বাতিল, মিথ্যা মামলা মোকর্দমা দায়ের সহ অনেক বিষয়ই উঠে এলো। তিনদিনের ই্ন্টারভিউ ক্যাম্পের সকলের আলোচনার বিষয়ে পরিনত হলো। এ্যামনেষ্টির একটি গ্রুপ আমার সাথে আলোচনার জন্য এলো। স্হানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো আমার উপস্হিতির খবর। কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। মিডিয়ায় দীর্ঘ এসব প্রতিবেদনে প্রকাশ পেলো জার্মানের এ্যাসাইলাম পলিসি ও মানবাধিকার সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর কথা। রাজনৈতিক সমস্যা সংকট ছাড়াও অর্থনৈতিক অবস্হা ছিলো অনেকটা বিধ্বস্হ। ভাষা শেখা ছাড়া জার্মানে কাজ করা অসম্ভব। বেঁচে থাকার মতো কিছু একটা তো করতেই হবে। মনে পড়লো আমার প্রিয় লেখক ম্যাক্সীম গোর্কীর কথা। সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতার বাইরে অন্য কোন কাজ করার বেদনা পরাভুত না হলেও অনেকটা নিস্তেজ হলো। মনে পড়লো বিএ অনার্স পরীক্ষার পর গ্রামে গিয়ে আমার কৃষিকাজ করার সিদ্ধান্তকে বাবা স্বাগত জানিয়েছিলেন। কেন সে অনুমুতি দিয়েছিলেন আজো তা রহস্যাবৃত। প্রথম দিনেই ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে শ্রমিকদের সাথে হালচাষ করেছিলাম । ফলশ্রুতিতে প্রচন্ড ঝর নিয়ে কুমিল্লায় ফিরে আসা। কৃষিকাজ আর করা হয়ে উঠেনি। সে পরাজয়ের গ্লানি এখনো আমাকে ত্বারিত করে। ভাবছিলাম তারপর ও কিছু একটা করতেই হবে। ডঃ উলরীচ ব্রিঙ্কম্যান, বাডেন-বুডেনেবার্গের পার্লাম্যান্ট সদস্য আমাদের ক্যাম্পে এসে হাজির। রেডক্রস ষ্টাফ এলিজাবেতের সহায়তায় আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছেন। এসেছেন ডঃ আলবেনশ্লেবেন। রিফিওজিদের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা হলো। রেডক্রস কনফারেন্স রুম আমার নিয়মিত মিটিং রুমে পরিনত হলো। রিফিওজি ও মানবাধিকার ইস্যুতে ক’ টি সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রাখলাম। ফ্রাইবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এজুকেশানের ডীন ডঃ গুইডু স্মীথ আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। ডঃ আলবেনশ্লেবেনকে নিয়ে সেখানে গেলাম । আলোচনা হলো একাডেমিক কিছু বিষয়ে। বিশাল মনের মানুষ ডঃ গুইডু স্মীথ। প্রস্তাব করলেন তার সাথে গবেষনা করার। ওনার অফিসের পার্শ্বের রুমটি ও আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি অবিভুত হলাম। ফ্রাইবুর্গ ছোট্র শহর হলেও এর অনেক ঐতির্য্য রয়েছে। রয়েছে ঐতির্হ্যবাহী ক’টি রেষ্টুরেন্ট। এরই একটিতে বসে কফি পান করছিলাম। সেখান হাজির হলো অপর এক শরনার্থী নাম তার রহিম সংগে এক জার্মান ভদ্রলোক । এগিয়ে এলেন আমারই দিকে। পিটার সিক, একজন আইনজীবি। দেলোয়ার একজন রিফিওজি ক্লেইম্যান্ট। পিটার সিক হাসলেন। জানি আপনাকে। ক’টা আর্টিক্যাল পড়েছি আপনার উপর। কি করছেন? মানে কোন কাজ কর্ম? বললাম খুজছি পাইনি এখনো। পিটার আবারো হাসলেন। আপত্তি না থাকলে আমার সাথে যোগদিন । এভাবেই পিটারের সাথে বন্ধুত্ব ও চাকুরীতে জড়িয়ে যাওয়া। পিটার ছিলো লোভ মোহের উর্দ্ধে উঠা এক বিচিত্র মানুষ। কোন আইনজীবি এমন হতে পারেন তা ছিলো আমার কল্পনার অতীত। তিন কক্ষ বিশিষ্ট এ ল চেম্বারটি ছিলো রিফিওজি ক্লেইম্যান্টদের জন্য এক আইনী আশ্রয় স্থল। ফ্রাইবুর্গ থেকে বার্লিন, হাজার মাইলের ব্যবধান তা সত্বে ও ক্লাইয়েন্ট আসতে শুরু করলো। মিডিয়ায় আমাদের উপস্থিতি এবং কয়েকটা ক্ষেত্রে সফলতা আমাদের আরো আত্মবিশ্বাসী করে তুললো। কিন্তু জার্মান সরকারের সাথে এ সংঘাতের পরিনতির কথা ভাবিনি আমরা দু’জনের কেউ। বাঙালী কমিউনিটির মধ্যেও ছিলো আত্মবিশ্বাসের আনন্দ। শিক্ষা, সংষ্কৃতি, সেবা সব ক্ষেত্রেই ছিলো আমাদের পদচারনা । গড়ে উঠেছিলো একটি বাংলাদেশী এসোসিয়শন। বাঙালী যুবক রেজা, মিজান, মিলন, রাহুল, মোশার্রফ, হুসাইন, জুয়েল, রফিক, আবিদ ও হেলমা সহ ৩০-৩৫ জন যুবক এবং কয়েকটি পরিবার ছিলো আমার খুবই ভক্ত এবং ল চেম্বারর ক্লাইয়েন্ট। এসোসিয়শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হিসাবে পূরো অঞ্চল চষে বেড়িয়েছি। আমার ১৯৯৭ সালে বিবিসি এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে জার্মান সরকারের তীব্র সমালোচনা, বার্লিনে ১৫জন বাঙালী যুবকের ডিপোর্টেশান রোধে প্রেস কনফারেন্স, এক পাকিস্থানী যুবকের টিভি সাক্ষাৎকার গ্রহন এবং পিটারের কিছু হেয়ালী কর্মকান্ডের কারনে তার লাইসেন্স বাতিল হলো। সরকার সব ফাইল ল’ প্রফেসর হাগারকে সমর্পন করলো। জার্মান সরকারের উদ্দেশ্য হাসিল হলো না। প্রফেসর হাগার ও আমায় চাকুরীতে নিলেন। পিটারের সম্পূর্ন বিপরীত একজন মানুষ। তবে নিঃসন্দেহে ছিলেন মানবিক ও নীতিবান। ১৯৯৯ সালে পালিয়ে এলাম প্যারিস হয়ে স্পেনে। ভগ্ন শরীর, ক্লান্ত, শ্রান্ত জীবন যুদ্ধের আরেক অধ্যায়। স্পেনের গালিসিয়ায় এসে ফিরে পেলাম নতুন । পন্তেভেদরা প্রদেশের সাংবাদিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাবিদ, শ্রমিক ও সাধারন মানুষ আমায় আপন করে নিল। ইউনিভার্সিটি অব ভিগোতে ফেলোশীপ পেলাম, পেলাম একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার সুযোগ। স্পেনীশ ভাষায় প্রকাশ হলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কলাম। প্রকাশিত হলো একটি শুরুর যাত্রা নামের ই- বুক। স্পেনের রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে বাংলাদেশ আবারো পরিচিত হলো। কন্যা এলমা ও ইসরাত রং তুলিতে ফুটিয়ে তুললো বাংলাদেশকে। তাদের সে ঘটনা বহুল স্মৃতি নিয়ে পাড়ি জমাতে হলো কানাডায়। তারপর কেটেছে ৮টি বছর। স্মৃতিপটে এখনো অম্লান জার্মান, ফ্রান্স এবং স্পেনের ঘটনা বহুল দিনগুলো। লেখকঃ নোটারী পাবলিক অব সাস্কাচুয়ান, হিউমান রাইটস এডভোকেট, একজন সাংবাদিক, জাতীয় সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রবন্ধ, ফিচার ও স্তম্ভ লেখক। কুমিল্লা প্রেসক্লাব ও কুমিল্লা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, এবং সমাজকন্ঠ সম্পাদক। লয়েড মিনিষ্টার, কানাডা নিবাসী। ফোনঃ ১ (৫৮৭) ৩৩৩ ২০৬৮।